কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট: ঢাকায় সফল কনস্ট্রাকশন প্রজেক্টের মূলমন্ত্র
- anjoncucse
- Mar 17
- 5 min read
আপনি কি কখনো ঢাকার কোন বিশাল কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট দেখে ভেবেছেন, "আরে বাপরে! এই কাজগুলো কিভাবে এত সুন্দরভাবে হয়?" বসুন্ধরা সিটির টাওয়ারগুলো, যমুনা ফিউচার পার্কের বিশাল কমপ্লেক্স, বা আমাদের সবার গর্বের মেট্রো রেল প্রজেক্ট - এই বিশাল বিশাল কাজগুলোর পিছনে আসলে কাজ করে একটি দক্ষ টিম, যারা "কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট" এর অসাধারণ দক্ষতা ব্যবহার করে আকাশচুম্বী ভিশন গুলোকে বাস্তবে পরিণত করে।
ঢাকার মতো একটি ব্যস্ত শহরে যেখানে জায়গা কম, ট্রাফিক বেশি, এবং ডেডলাইন টাইট - সেখানে একটি বাড়ি বা ভবন নির্মাণ করা মানেই একটা যুদ্ধ! আবার ভাবুন তো, সকাল ৯টায় সড়ক অবরোধ, দুপুর ২টায় ঝড়বৃষ্টি, বিকাল ৪টায় সিমেন্টের গাড়ি আটকে গেছে - এরকম পরিস্থিতিতে প্রজেক্ট শেষ করা কি কম চ্যালেঞ্জিং? আসুন দেখি কিভাবে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়!
কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কি?
সোজা বাংলায় বলতে গেলে, কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট হল আপনার বিল্ডিং প্রজেক্টের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক মতো করার একটি প্রক্রিয়া। ভাবুন আপনি একটা বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন - সময়মতো খাবার আসা চাই, গেস্টদের জায়গা ঠিক থাকা চাই, ডেকোরেশন সুন্দর হওয়া চাই - ঠিক তেমনই, নির্মাণ প্রকল্পে অনেক কিছু একসাথে ম্যানেজ করতে হয়।

একজন কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব - ঢাকার প্রেক্ষাপটে
আমাদের ঢাকা শহরে একজন ভাল কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট ম্যানেজার অনেকটা 'সবজান্তা' কাকার মতো। সেই বিখ্যাত পাড়ার কাকা যিনি সবার ঝামেলা সমাধান করে দেন, সবাইকে সঠিক পরামর্শ দেন। তার জানতে হবে:
ডিজাইন বিষয়ক জ্ঞান - ইঞ্জিনিয়ার এবং আর্কিটেক্টদের সাথে একসাথে কাজ করার জন্য। তাকে বুঝতে হবে বিল্ডিং কোড, রাজউকের নিয়ম, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন, আর্কিটেকচারাল ভাষা।
বাজেট ম্যানেজমেন্ট - টাকা-পয়সার হিসাব ঠিক রাখতে। ঢাকার অনেক এলাকায় একটি দশতলা বিল্ডিং করতে যে ১০-১২ কোটি টাকাও লাগে শুধু বিল্ডিং এর মেইন কনস্ট্রাকশন এ, সেই বাজেট ম্যানেজ করা কি কম কথা? রড, সিমেন্ট, ইট, বালু, শ্রমিক - সবকিছুর হিসাব রাখতে হবে।
সময় ব্যবস্থাপনা - নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে। বর্ষার আগে ছাদ ঢালাই শেষ না করলে পুরো প্রজেক্টই বিলম্বিত হবে। রমজানে কাজ কমে যাবে, ঈদে বন্ধ থাকবে - এসব বিবেচনায় রেখে সময়সূচি তৈরি করতে হবে।
রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট - লোকজন, কনস্ট্রাকশন এর সরঞ্জাম, মেটেরিয়াল সবকিছু ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারতে হবে । একসাথে ১০০ জন মিস্ত্রি থাকলে কাজ করার জায়গা হবে? স্ক্যাফোল্ডিং কখন কোথায় লাগবে? কংক্রিট মিক্সার কয়টা লাগবে?
বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয় - মালিক, ঠিকাদার, সাবকন্ট্রাক্টর, সাপ্লায়ার, রাজউক, ইউটিলিটি কোম্পানি, এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি - সবার সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে।
নির্মাণ ব্যবস্থাপনার ধাপগুলো - ঢাকা সিটির বাস্তবতায়
১. শুরুর ধাপ (ইনিশিয়েশন)
এই ধাপে আমরা একটি প্রজেক্ট সম্ভব কিনা তা যাচাই করি। ঢাকায় বাড়ি বানাতে যে মাথাব্যথা - জমি আছে কি না, রাজউকের অনুমোদন আছে কি না, প্লট নাম্বার ঠিক আছে কি না, নেইবারের সাথে বাউন্ডারি ওয়ালের সমস্যা আছে কি না - এইসব দেখার পর্যায় এটি।
ইনিশিয়েশন ফেইজে করণীয়:
ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা যাচাই)
প্রাথমিক বাজেট ক্যালকুলেশন
স্টেকহোল্ডার আইডেন্টিফিকেশন
প্রজেক্ট চার্ট তৈরি

২. ডিজাইন ধাপ
আর্কিটেক্ট ও ইঞ্জিনিয়াররা মিলে ঠিক করে কেমন হবে ঠিক আপনার ১০ কাঠার জমিতে ২০ তলা বিল্ডিং!
ডিজাইন ফেইজের প্রধান কাজগুলো:
কনসেপ্ট ডিজাইন (ধারণা গঠন)
স্কিমেটিক ডিজাইন (প্রাথমিক নকশা)
ডিটেইল ডিজাইন (বিস্তারিত নকশা)
কনস্ট্রাকশন ড্রয়িং (নির্মাণের জন্য বিস্তারিত নকশা)
স্পেসিফিকেশন ডেভেলপমেন্ট (বিস্তারিত স্পেসিফিকেশন)
৩. প্রি-কনস্ট্রাকশন ধাপ
নির্মাণের আগে তৈরি করতে হয় একটি রোডম্যাপ। ঠিক যেমন আমরা মিরপুর থেকে মতিঝিল যাওয়ার আগে রুট ঠিক করি - বাসে যাব, রিকশায় যাব, নাকি উবারে যাব? ফার্মগেটে ট্রাফিক জ্যাম, মহাখালীতে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি - এসব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিই।
ঢাকায় একটি মিড-সাইজ অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের প্রি-কনস্ট্রাকশন ফেইজে প্রজেক্ট ম্যানেজার দেখলেন, বর্ষা মৌসুম শুরু হলে কাজ বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বেইসমেন্ট এবং গ্রাউন্ড ফ্লোর ইফতারের আগে, এপ্রিল মাসের মধ্যে শেষ করবেন। তাই তিনি অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ করলেন এবং দ্বিতীয় শিফট চালু করলেন।
এই ধাপে:
রিসোর্স ঠিক করা (কত লোক লাগবে, কত সিমেন্ট লাগবে)
মিনি বাজেট তৈরি করা (ফাউন্ডেশনে কত খরচ, দেয়ালে কত)
সময়সূচি ঠিক করা (বর্ষা আসার আগে ছাদ ঢালাই শেষ করতে হবে!)
ঠিকাদার নিয়োগ
সাবকন্ট্রাক্টর নিয়োগ (ইলেকট্রিক, প্লাম্বিং, এসি ইত্যাদি)
বিস্তারিত কাজের ভাগ (ওয়ার্ক ব্রেকডাউন স্ট্রাকচার)
রিস্ক ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান
৪. প্রকিউরমেন্ট ধাপ
সঠিক মেটেরিয়াল, ঠিক দামে, ঠিক সময়ে কেনার ধাপ। ঢাকাতে নির্মাণ সামগ্রী কেনার জন্য - কোথায় যাবেন? কার কাছ থেকে কিনবেন? কখন কিনবেন? এই ধাপে সব ঠিক করা হয়।
একবার ভাবুন, প্রজেক্ট শুরু করার পর দেখা গেল রডের দাম কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে গেলো! কিংবা টাইলস অর্ডার দিলেন, কিন্তু চাইনা থেকে আসতে আসতে ৩ মাস লেগে গেল! তাই আগে থেকে প্ল্যান করা জরুরি।
প্রকিউরমেন্টের অংশ হিসেবে:
আগে থেকে সাপ্লায়ার তালিকা তৈরি
বড় ক্রয়ের জন্য কোটেশন সংগ্রহ
মেটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান
লজিস্টিক প্ল্যানিং
ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট
৫. নির্মাণ ধাপ
এখানেই আসল কাজ। গামছা কোমরে বেঁধে নেমে পড়তে হয়। মজুর থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, সেনেটারি মিস্ত্রি - সবাইকে নিয়ে একসাথে কাজ।
মনে রাখবেন, সবচেয়ে ভাল প্ল্যানেও ঝামেলা হতে পারে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল? হরতাল হয়ে গেল? সিমেন্টের দাম বেড়ে গেল? শ্রমিকরা ঈদে গ্রামে বড় ছুটিতে চলে গেল? এসব ম্যানেজ করতে হবে।
নির্মাণ ফেইজে জরুরি বিষয়:
কোয়ালিটি কন্ট্রোল
সাইট সুপারভিশন
প্রতিদিনের রিপোর্টিং
চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট
হেলথ ও সেফটি ম্যানেজমেন্ট
প্রগ্রেস ট্র্যাকিং
ঢাকার কনস্ট্রাকশনে সফল হওয়ার ৬টি মূল চাবিকাঠি
১. যোগাযোগ
ঢাকার ট্রাফিকে আটকে থাকলে সকাল ৮টায় সাইটে আসতে না পারলে প্রজেক্ট ম্যানেজারকে জানাতে হবে। ঠিকাদারকে জানাতে হবে। রড, সিমেন্ট ঠিক সময়ে আসছে না? জানাতে হবে। যোগাযোগই সবচেয়ে জরুরি।
নিয়মিত সাইট মিটিং
ডিজিটাল কমিউনিকেশন টুল ব্যবহার (হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, ইমেইল)
রিপোর্টিং সিস্টেম
ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশন (গ্রাফ, চার্ট) ইত্যাদি অপরিহার্য
২. পরিকল্পনা
বাঙালি হিসাবে আমরা "দেখা যাবে" এই শব্দটা খুব পছন্দ করি। কিন্তু নির্মাণ প্রকল্পে "দেখা যাবে" না! সামনে রমজান আসছে? আগে থেকে জেনে নিন কাজ কি বন্ধ থাকবে। ঈদের পরে সব মজুর গ্রামে চলে যাবে? প্ল্যান করুন। বর্ষা আসছে? তারও পরিকল্পনা করতে হবে।
ভাল পরিকল্পনার অংশ হিসেবে:
গ্যান্ট চার্ট তৈরি
রিসোর্স হিস্টোগ্রাম
মাইলস্টোন প্ল্যানিং
কন্টিনজেন্সি প্ল্যানিং
সিজনাল প্ল্যানিং (বর্ষা, শীত, ইত্যাদি)
৩. সঠিক টিম
শুধু যারা সস্তায় কাজ করবে তাদেরকে নিলেই হবে না। যারা সময়মতো, মানসম্মত কাজ করবে তাদের নিতে হবে। টিমের প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব পরিষ্কার থাকতে হবে।
টিম গঠনের সময় মনে রাখবেন:
অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা (যোগ্যতা একমাত্র মানদন্ড নয়)
টিম কেমিস্ট্রি (একসাথে কাজ করার ক্ষমতা)
স্পেশালাইজেশন (বিশেষায়িত দক্ষতা)
স্থানীয় জ্ঞান (ঢাকার বিল্ডিং কোড, রাজউকের নিয়ম সম্পর্কে ধারণা)
কমিউনিকেশন স্কিল
৪. সহযোগিতা
"আমার কাজ আমি করি, বাকিরা যা করে করুক" - এই মানসিকতা দিয়ে নির্মাণ কাজ সম্ভব না। পাশাপাশি থাকতে হবে সকলকে।
সহযোগিতা বাড়ানোর উপায়:
ক্রস-ফাংশনাল টিম ওয়ার্কিং
শেয়ার্ড গোল সেটিং
ইনফরমেশন শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম
টিম বিল্ডিং অ্যাক্টিভিটি
কোলাবোরেটিভ প্রবলেম সলভিং
৫. নিয়মিত ট্র্যাকিং
কোন পথে যাচ্ছি তা জানা জরুরি। প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে - কি কাজ হল, কি বাকি আছে, কোথায় সমস্যা হচ্ছে - সবকিছু ট্র্যাক করতে হবে।
ট্র্যাকিংয়ের উন্নত পদ্ধতি:
দৈনিক প্রোগ্রেস রিপোর্ট
সাপ্তাহিক স্টাটাস আপডেট
আর্নড ভ্যালু ম্যানেজমেন্ট (EVM)
Key Performance Indicator (KPI) ট্র্যাকিং
ভিজ্যুয়াল ড্যাশবোর্ড
৬. বিজনেস এবং ফিনেনশিয়াল মডেল
ঢাকা শহরে আপনি কিভাবে নির্মাণ করবেন? নিজে সবকিছু করবেন? একজন জেনারেল কন্ট্রাক্টর নিবেন? টার্নকি সলিউশন নিবেন? আপনার বাজেট এবং সময় অনুসারে সঠিক মডেল বেছে নিতে হবে।
বিভিন্ন বিজনেস মডেল:
ডিজাইন-বিড-বিল্ড (ট্রেডিশনাল)
ডিজাইন-বিল্ড (একসাথে ডিজাইন ও নির্মাণ)
কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাট রিস্ক (CMAR)
ইন্টিগ্রেটেড প্রজেক্ট ডেলিভারি (IPD)
টার্নকি (চাবি ধরানো পর্যন্ত দায়িত্ব)
পদ্মা সেতু আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট! এত বড় একটা প্রজেক্ট নিজেদের তত্ত্বাবধানে সফলভাবে শেষ করা গেছে ঠিক কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের সঠিক প্রয়োগের জন্য। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ভাল টিম, সময়ানুবর্তিতা, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, এবং কস্ট কন্ট্রোল - সবই ছিল অসাধারণ।
পদ্মা সেতু প্রজেক্টে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্টের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল রিস্ক ম্যানেজমেন্ট। পদ্মা নদীর প্রবল স্রোত, নদীর তলদেশের অস্থিরতা, এবং বর্ষায় পানির উচ্চতার পরিবর্তন - এসব চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে প্রজেক্ট টিম প্রতিটি পিলারের জন্য আলাদা আলাদা রিস্ক প্ল্যান তৈরি করেছিল। আবহাওয়া, জিওটেকনিকাল সমস্যা, লজিস্টিক চ্যালেঞ্জের জন্য তারা বিকল্প পরিকল্পনা প্রস্তুত রেখেছিল।
ঢাকা শহরে একটি সফল কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট শেষ করা মানে আপনি যদি আইফেল টাওয়ার বানিয়ে ফেলেছেন তার চেয়ে কম নয়! জ্যাম, বৃষ্টি, সরবরাহ সমস্যা, অনিয়মিত শ্রমিক - এত কিছুর মধ্যেও একটি প্রকল্প সফলভাবে শেষ করা যায় সঠিক ম্যানেজমেন্ট টেকনিক অনুসরণ করে।
মনে রাখবেন, ঢাকায় একটি সফল কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট মানে শুধু একটি বাড়ি নয়, একটি সাফল্যের গল্প, যেটা আপনি বছরের পর বছর ধরে গর্বের সাথে বলতে পারবেন।
Comments