আমাদের জীবনের হারিয়ে যাওয়া উঠোন
- anjoncucse
- Jul 22
- 2 min read
আজকাল ঘুম ভাঙার পর আমার মনে হয়—কিছু একটা ঠিক নেই। কিন্তু ঠিক কী, তা ধরতে পারি না।
আজ যেমন, ঘুম ভাঙল। শ্রাবণের মেঘে ঢাকা আকাশ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে মনে হলো, কিছু একটা নেই—একটা শূন্যতা।
অনেকক্ষণ পর মনে পড়ল—উঠোন।
আমাদের এই ফ্ল্যাটবাড়িতে কোনো উঠোন নেই। বারান্দা আছে। ছাদে যাওয়ার অনুমতি আছে। বারান্দার এক কোণে রাখা টবে কিছু ফুলের গাছও আছে। কিন্তু উঠোন নামক অদ্ভুত জিনিসটা নেই।
উঠোনের কথা মনে হতেই আমার দাদাবাড়ির কথা মনে পড়ল। আমি তখন ছোট। ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়ি।
বৃষ্টি হলেই আমার প্রধান কাজ ছিল উঠোনে নেমে কাদা মাখা। খালি পায়ে ভেজা মাটির উপর হাঁটলে ‘টুপ টুপ’ করে একটা শব্দ হতো। সেই শব্দের প্রতি আমার ছিল অদ্ভুত এক মুগ্ধতা।
আমার ছোট ভাইটা আমার পিছু পিছু আসত। একদিন সে কাদায় পিছলে পড়ে এমন আছাড় খেল যে তার প্যান্টের হাঁটু ছিঁড়ে একাকার। দাদি বারান্দায় একটা মোড়ায় বসে পুরো ঘটনাটা দেখছিলেন। আমি ভাবলাম, আজ আর রক্ষা নেই।
কিন্তু দাদি বারান্দা থেকে শুধু বললেন, ‘এই ছেলে, কাদা মেখে তো দেখি একেবারে বাঘ হয়েছিস!’
কথাটা শুনে আমি হো হো করে হেসে ফেলেছিলাম। দাদিও হাসছিলেন।
একটা বাড়ির কি মন থাকতে পারে? আমার মনে হয়, পারে। বাড়ির মন হলো তার উঠোন।
আমাদের উঠোনটা ছিল একাধারে আনন্দের এবং গভীর বিষাদের জায়গা। জীবনটা অনেকখানি গড়ে উঠেছিল সেই উঠোন ঘিরেই।
শীতের সকালে খেজুরের রস রাখা হতো উঠোনে। চুলার পাশে মাটির পিঁড়িতে বসে আম্মা ভাপা পিঠা বানাতেন, আমি গরম পিঠার আশায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
গন্ধ, ভাপ আর ঠান্ডা মাটির গায়ে লেগে থাকা একটা শীতল আনন্দ—এই ছিল উঠোনের গল্প।
ঈদের দিন সকালে নামাজে যাওয়ার আগে সবাই জড়ো হতো উঠোনে। পাঞ্জাবি পরা, হাতে জায়নামাজ ধরা মানুষগুলোকে দেখে আমি ভাবতাম—এরা সবাই এত খুশি কেন?
তখনো বুঝতাম না, এই খালি জায়গাটার মাঝেই কত স্মৃতি জমা হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য।
আর সেদিন… যেদিন দাদির জানাজা হয়েছিল, সেটাও হয়েছিল এই উঠোনেই।
যে উঠোনে তিনি গল্প করতেন, সকাল-সন্ধ্যা হেঁটে বেড়াতেন—সেই উঠোনই ছিল তাঁর বিদায়ের জায়গা। নিঃশব্দ কান্না আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো এক বিষণ্ণতা।
একটা উঠোন—শুধু জায়গা না, স্মৃতির পাত্র।
তবু আমরা সেই জায়গা হারিয়ে ফেলেছি। জমির দাম বেড়েছে, ঘর হয়েছে বারান্দা দিয়ে বাঁধানো, উঠোনের জন্য আর জায়গা থাকে না।
দাদির গল্প নেই, পিঠার গন্ধ নেই, খালি পায়ে কাদা মাখার আনন্দ নেই।
আমরা হয়তো উঠোন হারিয়েছি, কিন্তু তার চাহিদা হারিয়ে যায়নি।
জীবনের মাঝে এমন এক টুকরো ফাঁকা জায়গা দরকার, যেখানে একটু থেমে থাকা যায়।
তবু মাঝে মাঝে দেখি, মানুষ তার হারানো উঠোন খুঁজে বেড়াচ্ছে।
কেউ ছাদে বাগান করছে, কেউ বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে একা একা আকাশ দেখছে।
শহরের বড় অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সগুলোতেও মাঝে মাঝে একটা খোলা জায়গা রাখা হয়, যেখানে বাচ্চারা দৌড়ায়, সাইকেল চালায়।
এটাও হয়তো আধুনিক উঠোন—একটুখানি খোলা আকাশ।
কেউ হয়তো জানেই না কেন সে চায় একটা খোলা জায়গা, শুধু বোঝে—দম বন্ধ লাগে, একটু হাওয়া দরকার।
এই এক টুকরো খোলা জায়গা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এখনো আমাদের রক্তের মধ্যেই আছে।
দম বন্ধ হয়ে এলে মানুষ একটুখানি আকাশ চায়, একটুখানি মুক্তির নিঃশ্বাস চায়।
আমি স্থপতিদের দোষ দিই না। তাঁদের কাজেও এখন অনেক হিসেব—বাজেট, স্কোয়ারফুট, চাহিদা।
উঠোনকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ ধরে ফেলে রাখা হয়।
তবু যদি কেউ ডিজাইন করতে বসে নিজের শৈশবের উঠোনটা একটু মনে করত?
তাহলে হয়তো একটা ছোট্ট খালি জায়গা থেকে যেত—যেখানে কেউ দাঁড়িয়ে একটু নিঃশ্বাস নিতে পারত, কাদায় হেঁটে হঠাৎ করে হেসে উঠতে পারত, কিংবা শুধু চুপচাপ বসে থাকত—নিজের মতো করে।
Comments